স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ জনপদ এখন আর শুধু ফসলের মাঠ নয়, বিষের ভাগাড়ে রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে নাবিল গ্রুপের মালিকানাধীন “নাবা পোল্ট্রি অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম” এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চরম অব্যবস্থাপনা গত দুই দশকে রাজশাহীর পরিবেশকে করছে ভয়াবহভাবে দূষিত। খোলা আকাশের নিচে ফেলা হচ্ছে মুরগির বিষ্ঠা ও গবাদিপশুর মলমূত্র। এর ফলে শুধুমাত্র গন্ধ নয়, পানির উৎসও হয়ে পড়ছে বিষাক্ত। মানুষ হারাচ্ছে স্বাস্থ্য, প্রাণ হারাচ্ছে পরিবেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাট পৌরসভার গড়গড়া গ্রামে নাবিল গ্রুপের মুরগির খামারের বর্জ্য প্রতিদিন খোলা খাড়িতে ফেলা হচ্ছে। কোনো প্রকার প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই ফেলা এসব বিষ্ঠা থেকে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। কৃষিজমি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে, খাড়ির পানি কৃষিকাজে অনুপযুক্ত। এলাকার শিশুরা ভুগছে শ্বাসকষ্টে, বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছেন ত্বক ও অন্ত্রের রোগে।

২০০৬ সালে রাজশাহীর ভেরাপোড়া বাজারে শিমুল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে নাবিল গ্রুপ। পরবর্তীতে ২০১০ সালের মধ্যে তারা অটো রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল, ফিড মিল, ডাল মিল, কোল্ড স্টোরেজ এবং নাবিল ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে নাবিল গ্রুপের অধীনে ৯টি সহায়ক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ।

রাজশাহী বিভাগের পবা, গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘা, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, মান্দা, সাপাহার, চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুরসহ অন্তত ১৫টি উপজেলায় ছড়িয়ে রয়েছে নাবিল গ্রুপের পোল্ট্রি ও ডেইরি খামার। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাধিক মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ সত্ত্বেও তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

নাবিল গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) মো. বেলাল হোসেন দাবি করেন, “আমরা নিজেরা বর্জ্য ফেলি না, বরং থার্ড পার্টির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি।” তবে বাস্তবতা হলো, সেই ‘থার্ড পার্টি’ কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই খামারের বিষ্ঠা খোলা স্থানে ফেলছে। গভীর রাতে ট্রাকে করে বর্জ্য ফেলে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। এটি শুধু দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলই নয়, বরং পরিবেশ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন জানান, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি এবং প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।” কিন্তু স্থানীয়দের মতে, গত ১০ বছরে অন্তত ১২ বার অভিযোগ করা হলেও, কোনো কার্যকর শাস্তির উদাহরণ নেই। এমনকি রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার নিকটবর্তী খামারগুলো থেকেও অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য ফেলে হুজুরীপাড়া, বুলনপুর, কাদিরগঞ্জ এলাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি মুরগির খামার দৈনিক ১৫০-২০০ গ্রাম বিষ্ঠা তৈরি করে। একটি বড় খামারে প্রতিদিন তৈরি হয় কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য। এসব বর্জ্য কম্পোস্টিং, বায়োগ্যাস প্লান্ট বা নির্ধারিত ল্যান্ডফিলে প্রক্রিয়াজাত করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, “বর্জ্য পচে বায়ুবাহিত জীবাণু ছড়ায়। শিশু, বৃদ্ধ, এমনকি গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।”

এ অঞ্চলের খাড়ি, বিল ও ছোট নদীগুলোতে পাখি, মাছ, ব্যাঙ, শামুকসহ বহু প্রাণী বাস করত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব বর্জ্যের কারণে এসব জীববৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। পুকুরে মাছ চাষে দেখা দিচ্ছে সমস্য। বিষ্ঠা-পানিতে মাছের পচন ও বিষক্রিয়া বাড়ছে, মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকছে এসব দূষণ।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, অননুমোদিতভাবে বর্জ্য ফেলা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু নাবিল গ্রুপের মতো প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের অনাগ্রহ স্পষ্ট। পরিবেশ আদালতের অনুমতি ছাড়াই বহু খামার নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু রয়েছে।

নাবিল গ্রুপের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু মুনাফা নয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করাও তাদের সামাজিক দায়। গত দুই দশকে শুধু রাজশাহী নয়, গোটা বিভাগের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এই প্রতিষ্ঠানের খারাপ প্রভাব স্পষ্ট। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই জনপদের বাতাস, পানি, মাটি—সবই হয়ে উঠবে বিষাক্ত।

সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং নাবিল গ্রুপকে এখনই কঠোর নজরদারি, বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। নয়তো রাজশাহীর মানুষ শ্বাস নিতে পারবে না, কৃষক ফসল ফলাতে পারবে না, আর শিশু জন্ম নেবে এক বিষাক্ত ভবিষ্যতের দিকে। এমনটি প্রত্যাশা করছে সুশীল সমাজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *